কুরবানী

কুরবানীর পরিচয়

 কুরবান শব্দটি কুরবুন শব্দ থেকে নেয়া। অর্থাৎ নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার মাধ্যম হল কুরবানী তাই এর নাম কুরবানী। এই দিনে ঈদ পালন করা হয়ে থাকে এজন্য একে কুরবানীর ঈদ বলে। এ ঈদের অপর নাম ঈদুল আদ্বহা। আরবি শব্দ আদ্বহা অর্থ কুরবানীর পশু, যেহেতু এই দিনে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয়, তাই একে ঈদুল আদ্বহা বলা হয়।

কুরবানীর হুকুম

প্রথম মত: কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন।তাদের দলীল হচ্ছে-

১. আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন:—

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ  

অর্থঃ ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং (পশু) নহর (উট কুরবানিকে নহর বলা হয়) কর।’ [সূরা কাউছার, আয়াত: ২] আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব।

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

من وجد سعة ولم يضح- فلا يقربن مصلانا – رواه أحمد وابن ماجه- وصححه الحاكم

অর্থঃ ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।’ [আহমদ, ইবনু মাজাহ: ৩৫১৬]

যারা কুরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্ক-বাণী। তাই কুরবানি ওয়াজিব।

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

يا أيها الناس: إن على كل أهل بيت في كل عام أضحية . . رواه أحمد وابن ماجه- حسنه الألباني

অর্থঃ হে মানব সকল ! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কুরবানী দেয়া। [ ইবনু মাজাহ: ৩১২৫ ]

দ্বিতীয় মত: কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।এটি ইমাম মালেক ও শাফেয়ী রহ.-এর প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন: সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোনো জনপদের লোকেরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানী হল ইসলামের একটি শি‘য়ার বা মহান নিদর্শন। তাদের দলীল হচ্ছে

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

إذا رأيتم هلال ذي الحجة- وأراد أحدكم أن يضحي- فليمسك عن شعره وأظفاره- حتى يضحي – رواه مسلم

অর্থঃ ‘তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়, যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানী সম্পন্ন করার আগে তার কোনো চুল ও নখ না কাটে।’ [ মুসলিম: ১৯৭৭ ]

এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘যে কুরবানী করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝে আসে এটা ওয়াজিব নয়।

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে কুরবানী ওয়াজিব নয়।

সারকথা হল যারা কুরবানীকে ওয়াজিব বলেছেন তাদের প্রমাণাদি অধিকতর শক্তিশালী। আর ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত এটাই [মাজমূ ফাতাওয়া ৩২/১৬২-১৬৪]

কার উপর কুরবানী আবশ্যক

কুরবানীর পশু যবেহ করতে আর্থিকভাবে সামর্থবান ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব। সামর্থবান কাকে বলা হবে এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মতপার্থক্য রয়েছে।

১. হানাফী মাযহাবের আলেমদের মতে, ব্যক্তিগত আসবাব পত্র ও ঈদের দিনগুলোর মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার অতিরিক্ত যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।

২. একদল আলেমের মতে, ঈদের দিনগুলোতে কুরবানীর পশু খরিদ করার মত অর্থ যার কাছে রয়েছে সে কুরবানী আদায় করবে। (তাবয়ীনুল হাক্বাইক-৩/৬, শারহ আর-রিসালাহ- পৃ: ৩৬৭, হাশিয়াতুল বাজুরী ২/৩০৪, কাশ্শাফুল কিনা’ ৩/১৮)।

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস দ্বিতীয় মতটিকে শক্তিশালী করে। হাদীসে এসেছে :

«مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»

অর্থঃ যে কুরবানী করার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করে সে যদি কুরবানী না করে তবে সে যেন আমাদের ইদগাহে না আসে।’
এতে প্রমাণিত হয়েছে কুরবানীর পশু যবেহ করার স্বচ্ছলতাই এর জন্য অন্যতম শর্ত। কুরবানীর জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত নয়।

কুরবানী দাতার কুরবানী দেয়ার পূর্বে করনীয় কাজ

 যে ব্যক্তি কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা  করেছে তার জন্য ওয়াজিব; যুলহাজ্জ মাস প্রবেশের সাথে সাথে  অর্থাৎ ১ তারিখ থেকে কুরাবানীর পশু যবেহ না করা পর্যন্ত সে যেন তার দেহের কোন লোম বা চুল, নখ ও চর্মাদি না কাটে। এ বিষয়ে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘যখন তোমরা যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন কুরবানী না করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ (কাটা) হতে বিরত থাকে।’’ অন্য এক বর্ণনায় বলেন, ‘‘সে যেন তার (মরা বা ফাটা) চর্মাদির কিছুও স্পর্শ না করে।’’[মুসলিম]

বলিষ্ঠ মতানুসারে এখানে এ নির্দেশ ওয়াজিবের অর্থে এবং নিষেধ হারামের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কারণ, তা ব্যাপক আদেশ এবং অনির্দিষ্ট নিষেধ, যার কোন প্রত্যাহতকারীও নেই। কিন্তু যদি কেউ জেনে-শুনে ইচ্ছা করেই চুল-নখ কাটে, তবে তার জন্য জরুরী যে, সে যেন আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে। আর তার জন্য কোন কাফফারা  নেই। সে স্বাবাভাবিকভাবে কুরবানীই করবে।

যে সমস্ত পশু দ্বারা কুরবানী করা যায়

ইসলামি বিধান মতে সর্বমোট ছয় ধরনের গৃহপালিত পশু দিয়ে কুরবানি করা যায় তাহলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা।

১.উটঃ উটের বয়স ৫ বছর হতে হবে। একটি উটের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ জন  শরীক হতে পারবেন।

২.গরু,মহিষঃ গরু/ মহিষ এর বয়স ২ বছর হতে হবে। একটি গরু / মহিষের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ জন  শরীক হতে পারবেন।

৩.ছাগল,দুম্বা,ভেড়াঃ ছাগল,দুম্বা,ভেড়া এর বয়স ১ বছর হতে হবে। ছাগল,দুম্বা এবং ভেড়া এগুলোর মধ্যে কোন শরীক হতে পারবেন না।

পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কুরবানী দেয়া যাবে না

১. স্পষ্ট অন্ধ  অর্থাৎ যে পশু চোখে দেখে না অথবা একটি চোখে কিছুই দেখতে পায়না তাহলে এরুপ  পশু দ্বারা কুরবানী হবে না।  তবে যার চক্ষু সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু নষ্ট হয়নি তার কুরবানী সিদ্ধ হবে। কারণ, তা স্পষ্ট অন্ধ নয়।

২. রোগাক্রান্ত। যেসব পশু চরতে অথবা খেতে পারে না; যার দরুন দুর্বলতা ও গোশতবিকৃতি হয়ে থাকে। এরুপ পশু দ্বারা কুরবানী দেয়া যাবে না।

৩. এই পরিমাণ লেংড়া যে, জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না।

৪. যে পশুর শ্রবণশক্তি নেই।

৫. শিং ভেঙ্গে গেছে অথবা শিং উপড়ে গেছে। তবে জন্মগত ভাবে শিং না থাকলে কোনো সমস্যা নেই।

 ৬. পশু এমন পাগল যে, ঘাস পানি ঠিকমত খায় না। মাঠেও ঠিকমত চরানো যায় না। ।

৭. জন্মগতভাবে একটি  কান অথবা উভয় কান নেই।

৮. দাঁত মোটেই নেই বা অধিকাংশ নেই।

৯. স্তনের প্রথমাংশ কাটা।

কুরবানীর সময়কাল

কুরবানীর করার সময় হচ্ছে ১০ই জিলহজ্জ্ব অর্থাৎ ঈদের দিন ঈদের ছলাতের পর থেকে নিয়ে ১২ ই  যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত।অর্থাৎ কুরবানীর সময় হচ্ছে তিন দিন ।

বিঃদ্রঃ আমরা যদি  ঈদের ছলাতের পূর্বেই কুরবানীর পশু জবাই করে থাকি তাহলে আমাদের কুরবানী হবে না আবার নতুন পশু দ্বারা কুরবানী করতে হবে । কেননা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর হদিস 

আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) … জুন্দাব ইবনু সুফিয়ান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ঈদুল আযহায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি লোকদের সাথে ছলাত সম্পন্ন করে একটি বকরী দেখতে পেলেন, যা পূর্বেই যবেহ করা হয়েছে। তখন বললেনঃ সালাতের পূর্বে যে ব্যক্তি যবেহ করেছে, সে যেন এর স্থলে অন্য একটি বকরী যবেহ করে। আর যে যবেহ করেনি সে যেন এখন আল্লাহর নাম নিয়ে যবেহ করে। ’’ (মুসলিম)

তিনি (সঃ) আরও বলেন,
ঈদের খুতবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আজকের এই দিন আমরা যা দিয়ে শুরু করব তা হচ্ছে ছলাত। অতঃপর ফিরে গিয়ে কুরবানী করব। অতএব যে ব্যক্তি এরূপ করবে সে আমাদের সুন্নাহ (তরীকার) অনুবর্তী। আর যে ব্যক্তি (ছলাতের পূর্বে) কুরবানী করে নিয়েছে, তাহলে তা গোশতই; যা সে নিজের পরিবারের জন্য পেশ করবে এবং তা কুরবানীর কিছু নয়।’’(বুখারী , মুসলিম )

যবেহ করার নিয়ম

১.নিজ হাতে কুরবানী করা। মহানবী (সা.)-এর বহু সুন্নাত আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।  মহানবী (সা.)-এর সেসব হারিয়ে যাওয়া সুন্নতের অন্যতম হলো নিজ হাতে কোরবানি করা। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম নিজ হাতে কোরবানি করতেন। মদিনার জীবনে মহানবী (সা.) কখনো কোরবানি ত্যাগ করেননি।

ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন। প্রতিবছরই তিনি কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি)

ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’শিং ওয়ালা সাদা কালো বর্ণের দুটি দুম্বা কুরবানী করেন। তিনি আরও বলেন, আমি তাঁকে দুম্বা দুটি নিজ হাতে যবেহ করতে দেখেছি। আরও দেখেছি, তিনি সে দু’টির কাঁধের পাশে তার পা দিয়ে চেপে রাখেন এবং “বিসমিল্লাহ” ও “আল্লাহ আকবর” বলেন।

২.যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ্‌ ও আল্লাহু আকবার বলা।

৩.উঁট ছাড়া অন্য পশু হলে  বামকাতে শয়নাবস্থায় কেবলামুখি করে যবেহ করা । পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে যবেহ করা মুস্তাহাব।

আইয়ামে তাশরীক

 ৯ ই যিলহজ্ব ফজর থেকে ১৩ ই যিলহজ্ব আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরয ছলাতের পর প্রত্যেক বালেগ পুরুষ, নারী, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামায়াতের সঙ্গে ছলাত পড়ুক বা একাকি পড়ুক— প্রত্যেককেই একবার করে  তাকবীর পাঠ করতে হবে। তাকবীরটি হচ্ছে- 

اَللهُ أَكْبَرُ- اَللهُ أَكْبَرُ- لَااِلٰهِ إِلَّا اللهُ- وَاللهُ أَكْبَرُ- اللهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الحَمْدُ

উচ্চারণঃ ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ ।

অর্থঃ আল্লাহ্‌ সর্বোশ্রেষ্ঠ আল্লাহ্‌ সর্বোশ্রেষ্ঠ আল্লাহ্‌ ছাড়া কোনো ইলাহ্‌ নেই আল্লাহ্‌ সর্বোশ্রেষ্ঠ আল্লাহ্‌ সর্বোশ্রেষ্ঠ আর সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য।

আর এই আদেশ হাজ্বি-এবং যারা হজ্জ্ব করতে যাননি সকলের জন্য।পুরুষরা এই তাকবীরটি জোরে জোরে পাঠ করবেন আর মহিলারা এই তাকবীরটি আস্তে আস্তে পাঠ করবেন।ইমাম সাহেব পড়তে ভুলে গেলে মুক্তাদিরা ইমাম সাহেব কে স্মরণ করিয়ে দিবেন।