নফল ছওম

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ছওম।ছওম পালনের মাধ্যমে বান্দার আত্মিক ও শারীরিক অনেক কল্যাণ সাধিত হয়।রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) রমাদানের ফরয ছওম ব্যতীত প্রতি সপ্তাহে,প্রতি মাসে এবং বছর এর বিশেষ বিশেষ দিনে ছওম পালন করতেন এবং আমাদেরকেও পালন করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।নিম্নে আমরা নফল ছওম গুলোর আলোচনা পেশ করছি।

সোমবার ও বৃহস্পতিবার এর ছওম

রাসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) সপ্তাহে  সোম বার ও বৃহস্পতি বার ছওম পালন করতেন।

এ বিষয়ে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোম ও বৃহস্পতিবারের ছওমের প্রতি খুবই খেয়াল রাখতেন”।[তিরমিযী]

অন্য হাদিসে আবু কাতাদা আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সোমবারের ছওম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ঐ দিন আমার জন্ম হয়েছে এবং ঐ দিন আমার ওপর (কুরআন) নাযিল হয়েছে”।[সহীহ মুসলিম]

আল্লর রাসূল (সাঃ) অধিকাংশ সময় প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার ছওম রাখার  আরও একটি অন্যতম কারণ নিম্নের হাদিসগূলো থেকে আমরা জানতে পারি

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সোমবার ও বৃহস্পতিবারে (আল্লাহর দরবারে বান্দার) ‘আমাল পেশ করা হয়। তাই আমি চাই আমার ‘আমাল পেশ করার সময় আমি ছওম অবস্থায় থাকি। (তিরমিযী)

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবার ছওম রাখতেন। তাঁর কাছে জিজ্ঞাস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! (সাঃ) আপনি অধিকাংশ সময়ই সোম ও বৃহস্পতিবার ছওম রাখেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সোম ও বৃহস্পতিবার হলো ঐ দিন, যেদিন আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিমকে মাফ করে দেন। কিন্তু ওদেরকে মাফ করে দেন না যারা সম্পর্কচ্ছেদ করে রাখে। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)-কে (ফেরেশতাগণকে) বলেন, ওদেরকে ছেড়ে দাও যে পর্যন্ত তারা পরস্পর সম্পর্ক ঠিক করে নেয় (এরপর তাদেরকে মাফ করে দেয়া হবে)। (আহমদ, ইবনু মাজাহ)

আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামীন আমাদের সকল কে সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার ছওম রাখার তওফিক দান করেন আমীন।

শুক্রবারের ছওম

শুক্রবার মূলত সাপ্তাহিক ঈদের দিন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এটি সপ্তাহের ঈদের দিন, মুসলমানদের জন্য একটা মর্যাদাপূর্ণ দিন।’

তাই শুধুমাত্র এই দিনটিতে  নফল ছওম পালন করাকে রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) নিষেধ করেছেন।তবে যদি কেউ বৃহস্পতি ও শুক্রবার অথবা  শুক্র ও   শনিবার এইভাবে ছওম পালন করে থাকে অথবা আইয়ামে  বীয (প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারখ) এর ছওম   যদি কেউ পালন করে থাকে এবং সেটি  শুক্রবারে পড়ে যায় তাহলে কোনো সমস্যা নেই । কিন্তু শুধুমাত্র শুক্র বারের  জন্য নির্দিষ্ট করে ছওম পালন করা, এটি হাদিসে নিষেধ এসেছে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (সাঃ)কে বলতে শুনেছি যে,

لاَ يَصُومَنَّ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الجُمُعَةِ، إِلَّا يَوْمًا قَبْلَهُ أَوْ بَعْدَهُ

অর্থঃ তোমাদের কেউ যেন শুধু জুমু‘আর দিনে সাওম পালন না করে,তার (জুমু‘আর) আগে একদিন বা পরের দিন  ব্যতীত। [সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম ]

জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، دَخَلَ عَلَيْهَا يَوْمَ الجُمُعَةِ وَهِيَ صَائِمَةٌ، فَقَالَ: أَصُمْتِ أَمْسِ؟ قَالَتْ: لاَ، قَالَ: تُرِيدِينَ أَنْ تَصُومِي غَدًا؟ قَالَتْ: لاَ، قَالَ: فَأَفْطِرِي، وَقَالَ حَمَّادُ بْنُ الجَعْدِ: سَمِعَ قَتَادَةَ، حَدَّثَنِي أَبُو أَيُّوبَ، أَنَّ جُوَيْرِيَةَ، حَدَّثَتْهُ: فَأَمَرَهَا فَأَفْطَرَتْ

অর্থঃ (সাঃ) জুমু‘আর দিনে তাঁর নিকট প্রবেশ করেন তখন তিনি (জুযাইরিয়া) সাওম পালনরত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি গতকাল সাওম পালন করেছিলে? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আগামীকাল সাওম পালনের ইচ্ছা রাখ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে সাওম ভেঙ্গে ফেল। হাম্মাদ ইবনুল জা‘দ রহ. স্বীয় সূত্রে জুয়াইরিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আদেশ দেন এবং তিনি সাওম ভঙ্গ করেন।[ সহীহ বুখারী ]

মুহাম্মদ ইবন ‘আব্বাদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জাবির ইবন ‘আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে,

نَهَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ الجُمُعَةِ؟ قَالَ: نَعَمْ، زَادَ غَيْرُ أَبِي عَاصِمٍ، يَعْنِي: أَنْ يَنْفَرِدَ بِصَوْمٍ

অর্থঃ (সাঃ) কি জুমু‘আর দিনে (নফল) সাওম পালন করতে নিষেধ করেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। আবু ‘আসিম রহ. ব্যতীত অন্যেরা অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন যে, পৃথকভাবে জুমু‘আর দিনের সাওম পালনকে নিষেধ করেছেন। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]

আইয়ামে বীজ এর ছওম

“আইয়ামে বীজ” অর্থাৎ আলোকিত দিনসমূহ বলা হয় প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ কে। কারণ এই দিনগুলোতে চাঁদ সবচাইতে বেশি আলোকিত থাকে।  রাসূলুল্লাহ (সা.) আইয়ামে বীজের তিনদিন নিয়মিত সিয়াম পালন করতেন।

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আবূ যার! তুমি যখন কোন মাসে তিনদিন ছওম পালন করতে চাও, তাহলে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে করবে। (তিরমিযী ও নাসায়ী)

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أَوْصَانِي خَلِيلِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِثَلاَثٍ: صِيَامِ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيِ الضُّحَى، وَأَنْ أُوتِرَ قَبْلَ أَنْ أَنَامَ»

“আমার বন্ধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতি মাসে তিন দিন করে ছওম পালন করা এবং দু’রাক‘আত সালাতুদ-দোহা এবং ঘুমানোর পূর্বে বিতর সালাত আদায় করা”।[সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম]

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেনঃ হে ‘আবদুল্লাহ! আমি এ সংবাদ পেয়েছি যে, তুমি প্রতিদিন ছওম পালন কর এবং সারা রাত সালাত আদায় করে থাক। আমি বললাম, ঠিক (শুনেছেন) হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ এরূপ করবে না (বরং মাঝে মাঝে) ছওম পালন কর আবার ছেড়েও দাও। (রাতে) ছলাত আদায় কর আবার ঘুমাও। কেননা তোমার উপর তোমার শরীরের হাক্ব রয়েছে, তোমার চোখের হাক্ব রয়েছে, তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হাক্ব আছে, তোমার মেহমানের হাক্ব আছে। তোমার জন্য যথেষ্ট যে, তুমি প্রত্যেক মাসে তিন দিন ছওম পালন কর। কেননা নেক ‘আমলের বদলে তোমার জন্য রয়েছে দশগুণ নেকী। এভাবে সারা বছরের ছওম হয়ে যায়। আমি (বললাম) আমি এর চেয়েও কঠোর ‘আমল করতে সক্ষম। তখন আমাকে আরও কঠিন ‘আমলের অনুমতি দেয়া হল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আরো বেশি শক্তি রাখি। তিনি বললেনঃ তবে আল্লাহর নাবী দাঊদ (আঃ)-এর ছওম পালন কর, এর হতে বেশি করতে যেয়ো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নাবী দাঊদ (আঃ)-এর ছওম কেমন? তিনি বললেনঃ অর্ধেক বছর। রাবী বলেন, ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বৃদ্ধ বয়সে বলতেন, আহা! আমি যদি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত রুখসত (সহজতর বিধান) কবূল করে নিতাম! ( মুসলিম ,আহমাদ)

মুহাররম মাসের ছওম

মুহাররম, হিজরি সনের প্রথম মাস।মহান আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামীন যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন তম্মধ্যে  অন্যতম  মাস হচ্ছে মুহাররম।এই মাসটি  বরকতময় মাস। এ মাসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অধিক পরিমাণে নফল ছিয়াম এর কথা বলেছেন। তিনি (সাঃ) বলেন,

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ، وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ

অর্থাৎ, “রমাদানের সিয়ামের পর সর্বোত্তম ছওম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের ছওম এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হচ্ছে রাতের সালাত”।[সহিহ মুসলিম]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করা হলো, ফরয সালাতসমূহের পর কোন ছলাত এবং রমাদান মাসের সিয়ামের পর কোন ছওম সর্বোত্তম? বললেন, ফরয সালাতসমূহের পর গভীর রাতের ছলাত সর্বোত্তম এবং রমাদান মাসের সিয়ামের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের ছওম সর্বোত্তম”।[সহিহ মুসলিম]

 এ মাসের মধ্যে এমন একটি দিন আছে যাকে ‘আশুরার দিন’ বলা হয়। যে দিনটিতে ছওম রাখলে বিগত এক বছরের পাপরাশি মোচন হয়। (মুসলিম)

আশুরার ছওম

আশুরা অর্থ : আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশের’ (দশম) শব্দ থেকে এসেছে। ‘আশের’ হচ্ছে ‘আশারা’ (দশ) শব্দের বিশেষণ। অতএব আশুরা অর্থ হচ্ছে দশম বা দশক সেহেতু মুহাররম মাসের ১০ম দিবসকে আশুরা বলা হয়। (লিসানুল আরব, ৪/৫৬৯) ।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন-নবী করীম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা) যখন মক্কা হতে মদিনা শরীফে হিজরত করে মদিনা শরীফে তাশরীফ নিয়ে ছিলেন,তখন মদিনার ইহুদীদেরকে আশুরার ছওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা আশুরার ছওম কেন রাখ? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত, কেননা এই দিনে আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাইলদেরকে তাদের শত্রু ফেরাউন হতে পরিত্রান দিয়ে ছিলেন। এ কারনে আমরা ছওম এর মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরন সব সময় বিদ্যমান থাকে।হুজুর(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা)বললেন,হযরত মূসা (আলাইহিস সালাম) এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশি অধিকারী।অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা) নিজে ছওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে ছওম রাখার নির্দেশ দিলেন।[বুখারী,মুসলিম,আবু দাউদ ]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ মুহাররম ছওম রেখেছেন। কিন্তু ইহূদী ও নাছারারা শুধুমাত্র ১০ই মুহাররমকে সম্মান করত এবং ছওম পালন করত। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরোধিতা করার জন্য ঐ দিনসহ তার পূর্বের অথবা পরের দিন ছওম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব সুন্নাত হ’ল, ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররমে ছওম পালন করা। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
حِيْنَ صَامَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم
অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আশূরার ছওম পালন করলেন এবং ছওম পালনের নির্দেশ দিলেন, তখন ছাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ইহূদী ও নাছারাগণ এই দিনটিকে (১০ই মুহাররম) সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ ছওম  রাখব’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। [মুসলিম]

আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, و صِيَامُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ

অর্থঃ ‘আশুরা বা ১০ই মুহাররমের সিয়াম আমি আশা করি আল্লাহর নিকটে বান্দার বিগত এক বছরের (ছগীরা) গোনাহের কাফফারা হিসাবে গণ্য হবে’।
[মুসলিম, মিশকাত ]

শা‘বান মাসের ছওম

হিজরি অর্থাৎ আরবী বছর এর ৮ম মাস হচ্ছে শা‘বান। এ মাসটি রমাদান মাসের পূর্বের মাস রমাদানের প্রস্তুতি গ্রহনের মাস। রসুলুল্লাহ (সাঃ) এ মাসটিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন এ মাসের অধিকাংশ সময় তিনি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছওম পালন করতেন।

‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

لَمْ يَكُنِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ شَهْرًا أَكْثَرَ مِنْ شَعْبَانَ، فَإِنَّهُ كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ كُلَّهُ وَكَانَ يَقُولُ: خُذُوا مِنَ العَمَلِ مَا تُطِيقُونَ، فَإِنَّ اللَّهَ لاَ يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوا، وَأَحَبُّ الصَّلاَةِ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا دُووِمَ عَلَيْهِ وَإِنْ قَلَّتْ، وَكَانَ إِذَا صَلَّى صَلاَةً دَاوَمَ عَلَيْهَا

অর্থঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের চেয়ে বেশি (নফল) সাওম কোনো মাসে পালন করতেন না। তিনি (প্রায়) পুরা শা’বান মাসই সাওম পালন করতেন এবং বলতেন, তোমাদের সাধ্যে যতটুকু সাধ্য আছে ততটুকু (নফল) আমল কর। কারণ, তোমরা (আমল করতে করতে) ক্লান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা (সওয়াব দান) বন্ধ করেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় সালাতই ছিল তাই যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হত। যদিও তা পরিমাণে কম হো এবং তিনি যখন কোনো (নফল) সালাত আদায় করতেন পরবর্তীতে তা অব্যাহত রাখতেন।[সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]

অন্যহাদিসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ” يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ: لاَ يُفْطِرُ، وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ: لاَ يَصُومُ، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلَّا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ-

অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে (এত বেশি) সাওম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সাওম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) সাওম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সাওম পালন করবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ব্যতীত কোনো পুরা মাসের সাওম পালন করতে দেখি নি এবং শা’বান মাসের চেয়ে কোনো মাসে বেশি (নফল) সাওম পালন করতে দেখি নি”।[সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]

শাওয়াল মাসের এর ছয় ছওম

রমাদানের ছওম এর পর শওয়াল মাসের ৬টি ছওম রাখা সুন্নাত / মুস্তাহাব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রমাদানের ছওম রাখার পর-পরেই শওয়াল মাসে ছয়টি ছওম পালন করে সে ব্যক্তির পূর্ণ বৎসরের ছওম রাখার সমতুল্য সওয়াব লাভ হয়।’’

(মুসলিম ১১৬৪নং, সুনানে আরবাআহ; আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)

শাওয়াল মাসের ছওম পালন করার নিয়ম

শাওয়াল মাসের ছওম আমরা কিভাবে পালন করবো ।  এই ছয়টি ছওম কি  একসঙ্গে লাগাতার রাখতে হবে, না-কি বিরতী দিয়ে দিয়ে রাখতে হবে?

শাওয়াল মাসের ১ম দিন  ঈদূল ফিতর এর দিন  এবং এই দিনে ছওম পালন করা হারাম।এই দিনটি ব্যতীত শাওয়াল মাসের যেকোন ৬ দিন  সেটা লাগাতার ছয় দিন হউক কিংবা বিরতী দিয়ে ছয় দিন  হউক ছওম পালন করলে  হাদিস অনুযায়ী পূর্ণ বৎসরের ছওম রাখার সমতুল্য সওয়াব লাভ হবে ইংশাআল্লাহ্।

ইয়াওমুল আরাফা এর পরিচয়

জিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখকে (ঈদুল আযহার আগের দিন) ‘ইওয়ামুল আরাফাহ’ বা ‘আরাফার দিন’ বলা হয়,কারণ এই দিনে হাজ্জ্বিরা আরাফাহ্‌র ময়দানে একত্রিত হন। হজ্জ্বের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ আহকাম হলো যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ ‘আরাফার ময়দানে’ অবস্থান করা। এই দিনের গুরুত্ত্ব সম্পর্ক রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হলো হাজ্জ্ব।”

আরাফার দিনের ছওম এর ফজিলত

যারা হজ্জ্বে যাননি তাদের জন্য আরাফার দিন ছওম রাখা মুস্তাহাব। এই দিনে ছওম রাখা খুবই ফযিলতপূর্ণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিনের ছওম এর ব্যাপারে বলেছেন: “আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, এটি পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে।” (মুসলিম)

আবূ কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আরাফার দিনে ছওম রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, তা পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গোনাহ মোচন করে দেয়। ( মুসলিম ২৮০৪, আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ )

আরাফার দিনের ছওম কি আরবদেশের সাথে মিলিয়ে রাখবো নাকি ৯ ই যিলহাজ্জ রাখব?

হাদীসে ইয়াওমুল আ’রাফা অর্থাৎ আ’রাফার দিনের কথা এসেছে ৯ ই যিলহাজ্জ্বের কথা আসে নাই। আর উকুফে আরাফা হাজ্জ্বের সাথে সম্পর্কিত।তাই হাজ্জ্বিগন যে  দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করবেন সেই দিনই ছওম পালন করা অধিকাংশ আলেমদের অভিমত।তাছাড়া বাংলাদেশের সাথে সৌদিআরবের সময়ের ব্যবধান হচ্ছে মাত্র ৩ ঘণ্টা  তাই ইয়াওমুল আরাফার দিন ই ছওম রাখা বেশি যুক্তিযুক্ত।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে আরাফার দিন ছওম রাখার তাওফিক দান করেন আমী-ন।

নফল ছওম ভঙ্গ করা

যদি কোন ব্যক্তি নফল ছওম রাখে, তার জন্য তা ভাঙ্গ করা বা দিনের যে কোন অংশে তা ছেড়ে দেওয়া বৈধ।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তোমাদের কাছে (খাবার) কিছু আছে কি?’’ বললেন, ‘জী না।’ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তখন বললেন, ‘‘তাহলে আজকে আমি ছওম থাকলাম।’’ অতঃপর আর একদিন আমাদেরকে হাইস (খেজুর, পনীর ও ঘি একত্রিত করে প্রস্ত্তত খাদ্য বিশেষ) উপহার দেওয়া হয়েছিল। আমি তার থেকে কিছু অংশ তাঁর জন্য লুকিয়ে রেখেছিলাম। আর তিনি হাইস ভালোবাসতেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আজ আমাদেরকে হাইস উপহার দেওয়া হয়েছে। আর আমি আপনার জন্য কিছুটা লুকিয়ে রেখেছি।’ তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে নিয়ে এস। আমি সকাল থেকে ছওম অবস্থায় ছিলাম।’’ এ কথা বলে তিনি তা খেলেন এবং বললেন, ‘‘নফল ছওমদারের উদাহরণ ঐ লোকের মত যে নিজ মাল থেকে (নফল) সাদকাহ বের করে। অতঃপর সে চাইলে তা দান করে, না চাইলে রেখে নেয়।’’[, মুসলিম , আবূ দাঊদ , নাসাঈ]

অন্য হাদিসে  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘‘নফল ছওম পালনকারী নিজের আমীর। ইচ্ছা হলে সে ছওম থাকতে পারে, আবার ইচ্ছা না হলে সে তা ভাঙ্গতেও পারে।’’[আহমাদ, মুসনাদ , তিরমিযী, হাকেম,বাইহাকী ]

নফল ছওম পালন অবস্থায় যদি অতিথি আপ্যায়ন করাতে হয় বা আপ্যায়ন গ্রহণ করতে হয়, তাহলে নফল ছওম ছেড়ে দেওয়া জায়েজ হবে  যেমন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হাদিস-

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, একদা আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য খাবার তৈরী করলাম। তিনি তাঁর অন্যান্য সহচর সহ আমার বাড়িতে এলেন। অতঃপর যখন খাবার সামনে রাখা হল, তখন দলের মধ্যে একজন বলল, ‘আমার ছওম আছে।’ তা শুনে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তোমাদের ভাই তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে খরচ (বা কষ্ট) করেছে।’’ অতঃপর তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘ছওম ভেঙ্গে দাও। আর চাইলে তার বিনিময়ে অন্য একদিন ছওম রাখ।’’[বাইহাকী , ত্বাবারানী]