যাকাত (الزَّكَاةَ)

যাকাত কি ?

যাকাত ইসলামের পাঁচটি ভিত্তিসমূহের একটি ভিত্তি। যা ইসলামের মৌলিক ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম ইবাদত। প্রত্যেক মুসলমানকে যেমন যাকাত ফরয হওয়ার বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে যার উপর যাকাত ফরয তাকে তা নিয়মিত পরিশোধও করতে হবে। যাকাত একজন মুসলমানের অর্থ-সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে। যাকাতের শাব্দিক অর্থ পবিত্রতা, বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধি, বরকত ইত্যাদি। কারণ যিনি যাকাত প্রদান করবেন, তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং সাথে সাথে তা তাকে বালা-মুছিবত থেকেও রক্ষা করবে। যাকাত প্রদানকারীর মন পবিত্র হয়, তার সম্পদে বরকত হয় এবং তা বৃদ্ধি পায়।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন সুরা তওবার ১০৩ নং আয়াতে ঘোষণা দেন,

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلاَتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

অর্থঃ “হে নবী! আপনি তাদের (ধনীদের) ধনসম্পদ থেকে সদকা (যাকাত) নিয়ে তাদরেকে পাক পবিত্র করুণ, (নেকীর পথে) তাদেরকে এগিয়ে দিন এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করুণ। আপনার দোয়া তাদের সান্ত্বনার কারণ হবে। আল্লাহ সব কিছু শুনেন ও জানেন।” (সুরা তওবাঃ ১০৩)

যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

 যাকাত ছাড়া দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করে না। এবং যারা যাকাতের ফরয অস্বীকার করে তাদের কাফের বলে গণ্য করা হবে। এই যাকাত ফরয করা হয় ২য় হিজরীতে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন,

‏(‏وأقيموا الصلاة وآتوا الزكاة واركعوا مع الراكعين‏ ‏‏) ‏  

অর্থঃ ‘আর তোমরা ছলাত কায়েম কর, যাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে। (সূরা বাকারা : ৪৩)

‏ ‏(‏والذين في أموالهم حق معلوم للسائل والمحروم‏)‏ ‏

অর্থঃ ‘আর যাদের ধন সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার।’ [আল-মা’আরিজ ২৪,২৫]

এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে ছলাত এবং সিয়াম এর সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে সম্পৃক্ত, পক্ষান্তরে যাকাত ও হজ্বের সম্পর্ক অর্থের সাথেও রয়েছে। বিশেষভাবে যাকাত ধনী বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপরই ফরয হয়ে থাকে। হাদিস শরিফে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

تؤخذ من أغنيائهم وترد على فقرائهم

অর্থঃ ‘তাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে গ্রহণ করা হবে। আর তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা অভাবী তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।’ [আলবুখারী -১৪০১]

ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে যাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। হাদিসের ভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়েছে যাকাতের বিশেষ গুরুত্ব সংবলিত অনেক হাদিস।

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল আর ছলাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে।’ (বুখারি, মুসলিম)

জারির ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি ছলাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপর। (বুখারি, মুসলিম)

আবু সায়ীদ রা. বর্ণনা করেন,‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিন বার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত ছলাত পড়বে, রমযানের রোযা রাখবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’।’ (নাসায়ী: ২৩৯৫)

আবুদ্দারদা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘তোমরা নিজেদের মালের যাকাত প্রদান করে তা হিফাজত কর আর সদকা দিয়ে রোগীদের রোগ আরোগ্য কর।’

যারা যাকাত আদায় করে না তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ :

আল্লাহ তা‘আলা  সূরা আলে ইমরানের ১৮০ নাম্বার আয়াতে  ইরশাদ করেন-

وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

অর্থঃ আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন।

সুরা তাওবার ৩৪ ও ৩৫ নাম্বার আয়াতে ইরশাদ করেন-

– وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ – يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَـذَا مَا كَنَزْتُمْ لأَنفُسِكُمْ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ

অর্থঃ আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

ما من صاحب ذهب ولا فضة لا يؤدي حقها إلا إذا كان يوم القيامة صفحت له صفائح من نار فأحمي عليها في نار جهنم ، فيكوى بها جنبه وجبينه وظهره ، كلما بردت أٌعيدت في يوم كان مقداره خمسين ألف سنة ، حتى يقضى بين العباد، فيرى سبيله، إما إلى الجنة وإما إلى النار 

অর্থঃ ‘যে কোন স্বর্ণ বা রুপার মালিক যদি আপন সম্পদের মালের যাকাত আদায় না করে, তার এ সম্পদকে আল্লাহ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে কিয়ামতের দিন তা দ্বারা পিঠ, পার্শ্ব এবং কপালে ছ্যাকা দিবেন। আর যখনই তা ঠাণ্ডা হবে সাথে সাথে আগুনে পুণরায় উত্তপ্ত করা হবে। এমন দিনে তাকে শাস্তি দেয়া হবে যে দিনটি হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। আর বান্দার বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। অত:পর সে দেখতে পাবে তার গন্তব্য হয় জান্নাতের দিকে নয়তো জাহান্নামের দিকে।’

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

من آتاه الله مالاً فلم يؤد زكاته مثل له يوم القيامة شجاعاً أقرع له زبيبتان يُطوقه يوم القيامة ثم يأخذ بلهزمتيه – يعني شدقيه – يقول أنا مالُك أنا كنزك ” الشجاع : ذكر الحيات، والأقرع : الذي تمعط فروة رأسه لكثرة سُمه

অর্থঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই মুখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের সে দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’

সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

‘যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না। সে কিয়ামতের দিন একটি অগ্নিখণ্ড নিয়ে আসবে যা দ্বারা তার কপালে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে।’

বুরাইদা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

‘যে সম্প্রদায় যাকাত প্রদান করবে না আল্লাহ তাদেরকে দুর্ভিক্ষের মতো বিপদে নিপতিত করবেন।’

যাকাত গরিবের প্রতি কোন করুণা নয় বরং তার হক- যা ধনী ব্যক্তিকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ কারণে আবু বকর রা. বলেছেন,
‘যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর যুগে একটি উটের রশিও যাকাত হিসেবে আদায় করত আর এখন তারা যদি যাকাত দিতে অস্বীকার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ (বুখারি: ১৩১২)

তার এ ভাষণের মর্মার্থই ছিল, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যাতে কেউ কাউকে তার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে।