হাজ্জ্ব ও ওমরাহ্‌ (الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ)

হাজ্জ্ব এবং ওমরার গুরুত্ব ও ফযীলত:
ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের পঞ্চমটি হল হাজ্জ্বে বায়তুল্লাহ। ঈমান, ছলাত, যাকাত ও ছওম এর পরই হাজ্জ্বের অবস্থান। হাজ্জ্ব মূলত কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর হাজ্জ্ব পালন করা ফরয। অর্থাৎ হাজ্জ্ব আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচপাতি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত হাজ্জ্বে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হাজ্জ্ব আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হাজ্জ্ব আদায় করা ফরয। যা সক্ষম ব্যক্তির জীবনে একবারই ফরয। হাজ্জ্ব অস্বীকারকারী ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরুপে বের হয়ে যায়। আল্লাহ তা’লা বলেন,

وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلْبَيْتِ مَنِ ٱسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِىٌّ عَنِ ٱلْعَٰلَمِينَ

অর্থঃ এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হাজ্জ্ব করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী। ( সূরা আলে ইমরান,আয়াতঃ ৯৭)

হাজ্জ্ব ও ওমরার আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ

আভিধানিক অর্থঃ

হাজ্জ্ব শব্দটি ح বর্ণে ফাতহা যুক্ত করে حَجٌّ(হাজ্জুন) কিংবা কাছরা যুক্ত করে حِجٌّ (হিজ্জুন) উভয়ভাবেই পড়া যায়। ইমাম নববী রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, হাজ্জুন ফাতহা যুক্ত হলে মাসদার অর্থে হাজ্জ্ব করা অর্থে ব্যবহৃত হবে। হাজ্জ্বকে আরবিতে মানাসিকও (مناسك) বলা হয়। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে একাধিক স্থানে মানাসিক বলে হাজ্জ্বকে বুঝানো হয়েছে।

হাজ্জ্ব শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছা করা, সংকল্প করা ইত্যাদি। নিহায়া অভিধানে আছে যে, কোনো জিনিসের উদ্দেশ্যে সংকল্প করাকেই হাজ্জ্ব বলা হয়।যারা হাজ্জ্ব করেন তারা সাধারণত একটি বিশেষ পর্যায়ের সংকল্প, আকাঙ্ক্ষা ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হাজ্জ্ব করে থাকেন বিধায় একে হাজ্জ্ব বলে। হাজ্জ্ব আরবি শব্দ। অর্থ নিয়ত করা, দর্শন করা, সংকল্প করা, এরাদা করা, গমন করা, ইচ্ছা করা, প্রতিজ্ঞা করাসহ , কোনো মহৎ কাজে ইচ্ছা করা।

পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ

আর শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনে নিয়তসহ ইহরামরত অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, هوالقصد إلى البيت الحرام باعمال مخصوصة

অর্থাৎ বিশেষ কিছু আমল সম্পাদনসহ পবিত্র কা’বাগৃহের উদ্দেশ্যে গমন করাকে হাজ্জ্ব বলে। হাজ্জ্বের প্রধান লক্ষ্য হলো বায়তুল্লাহ শরিফের যিয়ারত- ইরশাদ হচ্ছে- إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِى بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَٰلَمِينَ

অর্থাৎনিশ্চই প্রথম ঘর, যা মানুষে জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা মক্কায়। যা বরকতময় ও হিদায়াত বিশ্ববাসীর জন্য। (সূরা আলে ইমরান,আয়াতঃ৯৬)

ওমরার আভিধানিক অর্থ:

যিয়ারত করা। শরীয়তের পরিভাষায় উমরা অর্থ, নির্দিষ্ট কিছু কর্ম অর্থাৎ ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ ও মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করার মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরীফের যিয়ারত করা। [ড. সাঈদ আল-কাহতানী, আল-উমরাতু ওয়াল হাজ্জ্ব ওয়ায যিয়ারাহ, পৃ. ৯।]

হাজ্জ্ব ও ওমরার ফযিলত

হাজ্জ্ব পালন উত্তম ইবাদাত:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ سُئِلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَيُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ إِيمَانٌ بِاللهِ وَرَسُولِهِ قِيلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ جِهَادٌ فِي سَبِيلِ اللهِ قِيلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ حَجٌّ مَبْرُورٌ

অর্থঃ হযরত আবূ হুরাইরাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, সর্বোত্তম আমল কোনটি ? তিনি বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। জিজ্ঞেস করা হলো, অতঃপর কোনটি ? তিনি বললেনঃ আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, অতঃপর কোনটি ? তিনি বলেনঃ হাজ্জ-ই-মাবরূর (মাকবূল হাজ্জ)। (বুখারী,হাদিস নং-১৫১৯)

অন্য রেওয়াতে রয়েছে:

عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ أَنَّهَا قَالَتْ يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم نَرَى الْجِهَادَ أَفْضَلَ الْعَمَلِ أَفَلاَ نُجَاهِدُ قَالَ لاَ لَكِنَّ أَفْضَلَ الْجِهَادِ حَجٌّ مَبْرُورٌ

অর্থঃ উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদকে আমরা সর্বোত্তম ‘আমল মনে করি। কাজেই আমরা কি জিহাদ করবো না ? তিনি বললেনঃ না, বরং তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হল, হাজ্জ্বে মাবরূর। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং-১৫২০)

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما ، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة

অর্থঃ আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক উমরা হতে অন্য উমরা, এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হাজ্জ্বে বিনিময় জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।”(বোখারি : হাদিস নং ১৬৫০)

হাদিসে আরো এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إن الإسلام يهدم ما كان قبله ، و أن الهجرة تهدم ما كان قبلها ، وأن الحج يهدم ما كان قبله

অর্থঃ ‘কারো ইসলাম-গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সকল গুনাহ মুছে দেয়, ও হাজ্জ্ব তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়। (মুসলিম : হাদিস নং১৭৩)

ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে,

تابعوا بين الحج والعمرة ، فإنهما ينفيان الفقر والذنوب كما ينفي الكير خبث الحديد والذهب والفضة وليس للحج المبرور ثواب إلا الجنة

অর্থঃ ‘তোমরা পর পর হাজ্জ্ব ও উমরা আদায় করো। কেননা তা দারিদ্র্য ও পাপকে সরিয়ে দেয় যেমন সরিয়ে দেয় কামারের হাপর লোহা-স্বর্ণ-রুপার ময়লাকে। আর হাজ্জ্বে মাবরুরের ছোয়াব তো জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।–(সহিহুন্নাসায়ি : ২/৫৫৮)

উপরে উল্লেখিত হাদিসসমূহের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তাই হাজ্জ্ব পালনেচ্ছু প্রতিটি ব্যক্তিরই উচিত পবিত্র হাজ্জ্বের এই ফজিলতসমূহ ভরপুরভাবে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাওয়া। হাজ্জ্ব কবুল হওয়ার সকল শর্ত পূর্ণ করে সমস্ত পাপ ও গুনাহ থেকে মুক্ত থেকে কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।

হাজ্জ্ব ও ওমরা পালনকারীগন আল্লাহর মেহমান-

হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ ‏ “‏ الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ وَفْدُ اللَّهِ دَعَاهُمْ فَأَجَابُوهُ وَسَأَلُوهُ فَأَعْطَاهُمْ

অর্থঃ হযরত ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: আল্লাহর পথের সৈনিক, হাজ্জ্বযাত্রী ও উমরা যাত্রীগণ আল্লাহর প্রতিনিধি। তারা আল্লাহর নিকট দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন এবং কিছু চাইলে তা তাদের দান করেন। (ইবনু মাজাহ,হাদিস নং-২৮৯৩)

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ أَنَّهُ قَالَ ‏ “‏ الْحُجَّاجُ وَالْعُمَّارُ وَفْدُ اللَّهِ إِنْ دَعَوْهُ أَجَابَهُمْ وَإِنِ اسْتَغْفَرُوهُ غَفَرَ لَهُمْ

অর্থঃ হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: হাজ্জ্বযাত্রীগণ ও উমরার যাত্রীগণ আল্লাহর প্রতিনিধিদল। তারা তাঁর নিকট দোয়া করলে তিনি তাদের দোয়া কবুল করেন এবং তাঁর নিকট মাফ চাইলে তিনি তাদের ক্ষমা করেন। (ইবনু মাজাহ, হাদিস নং-২৮৯২)

হাজ্জ্বের প্রকারভেদ:

হাজ্জ্ব তিন প্রকার। যথাঃ ১. তামাত্তু ২. কিরান ৩. ইফরাদ।

হাজ্জ্বে তামাত্তু:

হাজ্জ্বের মাসগুলোতে ( শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহাজ্জ্ব ) শুধু ওমরার নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে মক্কায় পৌছার পর ওমরার ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করে ইহরাম খুলে ফেলা এবং উ’কুফে আরাফার পূর্বে শুধুমাত্র হাজ্জ্বের নিয়ত করে পুনরায় ইহরাম বাঁধার নাম হাজ্জ্বে তামাত্তু। হাজ্জ্বে তামাত্তু ও হাজ্জ্বে কেরান-এ শোকরানা স্বরূপ হাজ্জ্বের দম ওয়াজিব হয় এবং এ কুরবনি ধনী হওয়ার কারণে যে কুরবানি আসে তা থেকে ভিন্ন।

হাজ্জ্বে কেরানঃ

একই ইহরামে ওমরা ও হাজ্জ্ব কার্য সম্পাদন করাকে হাজ্জ্বে কেরান বা কেরান হাজ্জ্ব বলে। মিকাতের বাইর থেকে আগত ব্যক্তিই কেরান হাজ্জ্ব করতে পারবে। কেউ কেরান হাজ্জ্ব করতে চাইলে মিকাতে প্রবেশের পূর্বেই একসাথে ওমরা ও হাজ্জ্বের নিয়তে ইহরাম ধারন করে মক্কা মুকাররামায় এসে ইযতিবা ও রমল সহকারে তাওয়াফ ও সাঈ।

হাজ্জ্বে ইফরাদঃ

শুধূমাত্র হাজ্জ্বের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে হাজ্জ্ব করার নাম ইফরাদ হাজ্জ্ব। ইফরাদ হাজ্জ্বের এ ইহরাম সম্পূর্ণ হাজ্জ্ব শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকবে। এ হাজ্জ্বে কুরবানি ওয়াজিব নয়। কেউ ইচ্ছা করলে করতে পারে। তা নফল হবে। এই তিন প্রকারের হাজ্জের মধ্যে কিরান হাজ্জ সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ একটি হাজ্জ।

হাজ্জ্ব যাদের উপর ফরয:

(১) মুসলিম হওয়া ।

(২) বালিগ হওয়া ।

(৩) স্বাধীন হওয়া।

(৪) বিবেকবান হওয়া ।

(৫) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যে ব্যক্তির এ পরিমাণ ধনসম্পদ আছে যে, সে হাজ্জ্বের সফর (পথ খরচ) বহন করতে সক্ষম এবং তার অনুপস্থিতিকালীন তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন মেটানোর মতো খরচও রেখে যেতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির ওপর হাজ্জ্ব ফরজ।

(৬) যাতায়াতে নিরাপত্তা

(৭) মহিলাদের সাথে মুহরিম থাকা।

আইয়্যামে হাজ্জ্বের বিভিন্ন নামসমূহ:

১. যিলহাজ্জ্বের আট তারিখকে ‘ইয়াউমুত তারউইয়্যাহ’।

২.নয় তারিখকে ‘ইয়াউমুল আরাফাহ’।

৩. দশ তারিখকে ‘ইয়াউমুন নাহর।

৪. এগারো তারিখকে ‘ইয়াউমুল ওকুফ’।

৫. বারো তারিখকে ‘ইয়াউমুল নাফরিল আওয়াল’ এবং

৬. তেরো তারিখকে ‘ইয়াউমুল নাফরিস সানি’ বলে।

হাজ্জ্বের ফরজ ৩টি:

১। ইহরাম বাধা:

ইহরাম শব্দের অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ করা।ইহরামের অবস্থা ধারণ করলে কিছু হালাল ও মুবাহ কাজও মুহ্‌রিমের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।  ইহরামের জন্য ধারাবাহিক ভাবে নিম্নের ৭ টি কাজ করতে হবে।

(ক)  হাত পায়ের নখ , বগল ও নাভীর নিচের চুল পরিষ্কার করবেন।

(খ) গোসল অথবা অযু করবেন।তবে গোসল করাই উত্তম।

(গ) ইহ্‌রামের কাপড় পরিধান করা।পুরুষের জন্য সেলাইবিহীন দুটি চাদর পরিধান করা।একটি লুঙ্গির মত পরা, অন্যটি চাদরের মত গায়ে জড়নো। নারীরা হাজ্জ্ব ও ওমরাহ্‌ পালনের জন্য ইহরামের পোশাক হিসেবে যে কোনো ধরনের শালীন পোশাকই পরিধান করতে পারবেন। তারা এমন পোশাক পরিধান করবে যাতে পর্দার খেলাপ এবং কু-দৃষ্টি ও ফেতনার আশংকা না হয়।
তথাপিও তাদের পোশাক নির্বাচনে কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরি। আর তাহলো-

>> ভালোভাবে সতর ঢাকা যায় এমন পোশাকই নারীরা ইহ্‌রাম অবস্থায় পরিধান করবে।
>> আঁট-সাঁট, ফিটিংস; শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে এমন পোশাক পরিধান করা যাবে না।
>> খুব রংচটে পোশাক পরিধান করা যাবে না; যা পরিধান করলে অন্য পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

(ঘ)  সামান্য (পুরুষরা) আতর ও সুগন্ধি গ্রহণ করা।তবে আতর বা সুগন্ধি ইহ্‌রামের কাপড়ে লাগানো যাবে না।

(ঙ) ২ রাকাত ছলাত আদায় করা।

(চ)হাজ্জ্ব ও ওম্‌রাহ্‌ এর নিয়ত করা।ছলাত ও অন্যান্য সকল ইবাদাতের নিয়ত করতে হয় মনে ইচ্ছা পোষণ করে। তবে ইহ্‌রামের সময় মুখে শুধু হাজ্জ্ব বা উমরা শব্দ উচ্চারণ করতে হয়।

ওম্‌রাহ্‌ এর নিয়তঃ

لَبَّيْكَ عُمْرَةَ

উচ্চারণঃ লাব্বাইকা উমরাহ্‌।

হাজ্জ্ব এর নিয়তঃ

لَبَّيْكَ حَجَّا

উচ্চারণঃ লাব্বাইকা হাজ্জা।

(ছ) তালবিয়া পাঠ করবেন।যখন তালবিয়া পাঠ করবেন তখন ৩ বার পাঠ করবেন।পুরুষরা সামান্য উচ্চ আওয়াজে এবং মহিলারা নিম্ন স্বরে পড়বেন।প্রথম ইহরাম করার সময় ক্বিবলামুখী হয়ে তালবিয়া পড়া সুন্নাত।(সহীহ বুখারী)

لَبَّيْكَ اللّهُمَّ لَبَّيْكْ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكْ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكْ ، لا شَرِيْكَ لَكْ
উচ্চারণঃ  ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্‌দা ওয়ান নি’মাতা, লাকা ওয়াল মুল্‌ক লা-শারীকালাক’।

অর্থঃ আমি হাজির হয়েছি হে আল্লাহ্‌, তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির হয়েছি।আমি হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির।নিশ্চই  সমস্ত প্রসংশা ও নিয়ামত তোমারই এবং রাজত্ব ও সার্বভৌমত্ব ও তোমার।তোমার কোন শরীক নেই।

২। উ’কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান):

জিলহাজ্জ্ব মাসের ৯ তারিখ ফজরের পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা।

৩। তাওয়াফুয্ যিয়ারাহ্‌ঃ

ইহ্‌রাম থেকে প্রাথমিক হালাল হওয়ার পর গোসল করে ফ্রেশ হয়ে স্বাভাবিক পোশাক পরবেন, আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করবেন এবং তাওয়াফে যিয়ারাহ্‌ করবেন।এই তাওয়াফে রমল ও ইজতিবা নেই।তাওয়াফে যিয়ারাহ্‌ ১০ই যুলহাজ্জাহ্‌ তারিখে করাই সর্বোত্তম।এ দিন করা সম্ভব না হলে ১১,১২ ও ১৩ই যুলহাজ্জ তারিখেও দিনে ও রাতে যে কোন সময় এ তাওয়াফ করতে পারবেন।

হাজ্জ্বের ওয়াজিব ৬টি :

(১) ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দ্বয়ের মাঝে ৭ বার সাঈ করা। সাঈ করার নিয়ম হচ্ছে  সাফা পাহাড় থেকে শুরু করবেন। সাফা থেকে যখন মারওয়া পাহাড়ে আসবেন তখন আপনি একবার সাঈ করলেন।আবার মারওয়া পাহাড় থেকে যখন সাফা পাহাড়ে আসবেন তখন ২ বার সাঈ করলেন এই ভাবে মোট ৭ বার সাঈ করবেন।

(২) উ’কুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহাজ্জ্ব) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যদয় পর্যন্ত একমুহুর্তের জন্য হলেও অবস্থান করা।

(৩) মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিক্ষেপ করা।

(৪) ‘হাজ্জ্বে তামাত্তু’ ও ‘ক্বিরান’ কারীগণ ‘হাজ্জ্ব’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।

(৫) এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।

(৬) মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা। এছাড়া আর যে সমস্ত আমল রয়েছে সব সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব।

ওমরার ফরজ:

দুইটি ফরজ-

(১) ইহরাম পরিধান করা

(২) তাওয়াফ

ওমরার ওয়াজিব দুইটি :

(১) সাফা ও মারওয়া মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সাঈ করা।

(২) মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ :

(১) সেলাইযুক্ত যে কোন কাপড় ব্যবহার করা।

(২) মস্তক ও মুখমন্ডল (ইহরামের কাপড়সহ যে কোন কাপড় দ্বারা) ঢাকা,

(৩) পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।

(৪) চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা

(৫) নখকাটা

(৬) ঘ্রানযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো।

(৭) স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা।

(৮) যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ বা কোন কথা বলা।

(৯) শিকার করা।

(১০) ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা।

(১১) চুল দাড়িতে এমনভাবে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা, যাতে ছিড়ার আশংকা থাকে।

(১২) শরীরে সাবান লাগানো।

(১৩) উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোন জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা।

(১৪) কোন গুনাহের কাজ করা ইত্যাদি।

তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ :

(১) শরীর পাক-সাফ রাখা, ওজু করা। মহিলাদের হায়েজ নেফাছ অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েজ নাই।

(২) ছতর ঢাকা। অর্থাৎ যেটুকু ঢাকা প্রত্যেক পুরুষ-নারীর জন্য ফরজ।

(৩) ‘হাতীমে কা’বার’ বাইরে থেকে ‘তাওয়াফ’ করা।

(৪) পায়ে হেঁটে ‘তাওয়াফ’ করা। অক্ষম ব্যক্তি খাটিয়ার মাধ্যমে ‘তাওয়াফ’ করতে পারেন।

(৫) ‘হাজরে আস্ওয়াদ’ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে ‘তাওয়াফ’ শুরু করা।

(৬) এক নাগাড়ে বিরতিহীন ভাবে ‘সাতবার চক্কর’ দিয়ে ‘তাওয়াফ’ পূর্ণ করা।

(৭) ‘সাত চক্করে’ এক ‘তাওয়াফ’, এটা পূর্ণ হলেই ‘তাওয়াফের’ ছলাত পড়া।

তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী :

(১) ‘তাওয়াফে’র শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এর দিকে মুখ করা।

(২) সম্ভব হলে ‘হাজরে আস্ওয়াদ’ চুম্বন করা। নতুবা হাত দ্বারা দূর থেকে ইশারা করা, এবং মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ বলা।

(৩) ‘হাজরে অস্ওয়াদ’ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরিমা’র ন্যায় উভয় হাত সিনা পর্যন্ত উঠান।

(৪) যে ‘তাওয়াফে’র পরে ‘সাঈ’ আছে তাতে ‘এযতেবা’ করা। অর্থাৎ ইহরামের চাদরের (উপরের অংশের) দুই মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর ফেলে দেওয়া।

(৫) ‘সাঈ’ যুক্ত ‘তাওয়াফে’র প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা। তথা বীরের মত হেলে দুলে জোর ক্বদমে (একের পর এক পা ফেলে) চলা।

(৬) বাকী চার চক্কর সাধারণ গতিতে (ধীরে ধীরে) সম্পন্ন করা।

(৭) প্রত্যেক চক্কর তাওয়াফ শেষ করে এবং শেষ চক্করেরও পরে ‘হাজরে অস্ওয়াদ’কে চুম্বন করা। সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে বিসমিল্লাহে আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ্” দোয়াটি পাঠ করা এবং ৩ নং নিয়মের ন্যায় দাড়িয়ে ইশারা করে ‘তাওয়াফ’ শেষ করা।

তালবিয়া :

”লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক, লাব্বাঈক, লা-শারীকা-লাকা লাব্বাঈক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক।”

অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোন অংশীদার নেই।

হাজ্জ্ব একবারই ফরয:

হাজ্জ্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরয হয়। একবার ফরয হাজ্জ্ব আদায়ের পর পরবর্তী হাজ্জ্বগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন- হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হাজ্জ্ব ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হাজ্জ্ব করো। এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রতি বছর কি হাজ্জ্ব করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা (প্রতি বছর হাজ্জ্ব করা) ফরয হয়ে যেতো, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না।(সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৩৭ (৪১২); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১০৬০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭০৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫০৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১০; শরহে মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১৪৭২; সুনানে দারাকুতনী ২/২৮১)

ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত অনুরূপ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, হাজ্জ্ব (ফরয) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য।(মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩০৪; সুনানে দারিমী, হাদীস : ১৭৮৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ৩২০৯)

বিনা ওজরে হাজ্জ্ব বিলম্ব না করা উত্তম:

হাজ্জ্ব যেহেতু একবারই ফরয তাই যার উপর হাজ্জ্ব ফরয হয়েছে সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হাজ্জ্ব আদায় করে, তবে তার ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হাজ্জ্ব বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও আসল হুকুম হচ্ছে হাজ্জ্ব ফরয হওয়ার সাথে সাথে আদায় করা। বিনা ওজরে বিলম্ব না করা। কারণ বিনা ওজরে বিলম্ব করাও গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয হাজ্জ্ব আদায়ের প্রতি এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, কেউ যদি এই হাজ্জ্বকে অস্বীকার করে বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত ও হতভাগ্যরূপে বিবেচিত হবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হাজ্জ্ব করা ফরয। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।( সূরা আলে ইমরান: ৯৭ )

তাছাড়া যে কোনো ধরনের বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হওয়া বা মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। তাই হাজ্জ্ব ফরয হওয়ার পর বিলম্ব করলে পরে সামর্থ্য হারিয়ে ফেললে বা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলার নিকট অপরাধী হিসেবেই তাকে হাজির হতে হবে।

এজন্যই হাদীস শরীফে হাজ্জ্ব ফরয হওয়ামাত্র আদায় করার তাগিদ ও হুকুম দেওয়া হয়েছে।

ইবনে আববাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি হাজ্জ্ব করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭৩২; সুনানে দারিমী, হাদীস : ১৭৮৪; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৮৭; তবারানী, হাদীস : ৭৩৮।)

অন্য বর্ণনায় ইরশাদ হয়েছে, ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ফরয হাজ্জ্ব আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ২৮৬৭; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/৩৪০)

উপরন্তু একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা যে স্বচ্ছল সামর্থ্যবান ব্যক্তি হাজ্জ্ব আদায় করে না তাকে হতভাগা ও বঞ্চিত আখ্যায়িত করেছেন।

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার রিযিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার গৃহের হাজ্জ্বের উদ্দেশ্যে আগমন না করে তবে সে হতভাগা, বঞ্চিত।(সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৫; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ১০৩১; তবারানী, হাদীস : ৪৯০; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৫/২৬২; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৫৯)

হাজ্জ্ব করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হাজ্জ্ব করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে।

ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- যে ব্যক্তি হাজ্জ্ব করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হাজ্জ্ব করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।(তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮)

তিনি আরো বলেন,

আমার ইচ্ছে হয় কিছু লোককে বিভিন্ন শহরাঞ্চল ও লোকালয়ে পাঠিয়ে দিই, তারা সেখানে দেখবে, কারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হাজ্জ্ব করছে না। তারা তাদের উপর কর আরোপ করবে। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়।(তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮)

যারা হাজ্জ্ব-উমরা না করে সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টা করে ইসলাম তা কখনো অনুমোদন করে না।

ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ইসলামে বৈরাগ্য নেই। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হাজ্জ্বের ক্ষেত্রে কোনো বৈরাগ্য নেই।(মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৩১১৩, ৩১১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৮৬; তবারানী, হাদীস : ১১৫৯৫; শরহু মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১২৮২)

ইকরামা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হল, সারুরা কী? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হাজ্জ্ব-উমরাহ কিছুই করে না অথবা যে ব্যক্তি কুরবানী করে না।(শরহু মুশকিলুল আছার ২/২১৫-১৬)

সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, জাহেলী যুগে যখন কোনো ব্যক্তি হাজ্জ্ব করত না তখন তারা বলত, সে সারুরা (বৈরাগী)। তখন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইসলামে বৈরাগ্য নেই।(শরহু মুশকিলুল আছার ২/২১৫-১৬)

যারা হাজ্জ্বের সফরের সৌভাগ্য লাভ করেন তারা যেন আল্লাহর মেহমান। তাই প্রত্যেকের উচিত সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য ও তার ইশক-মুহববতের অনুভূতি নিয়ে সেখানে অবস্থান করা। বায়তুল্লাহ ও আল্লাহর অন্যান্য শেআর ও নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। দ্বন্দ-কলহ, ঝগঙা-বিবাদ এবং অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে সর্বাত্মকভাবে দূরে থাকা। কুরআন-হাদীসে এ সম্পর্কে বিশেষ হুকুম নাযিল হয়েছে।

হাজ্জ্বের প্রস্তুতি:

১. হাজ্জ্বে গমনকারীর জন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করা। কারণ বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া আল্লাহ তাআলা বান্দার কোন ইবাদত কবুল করেন না। অন্তরে যেন বিন্দু পরিমান লৌকিকতা-লোক দেখানো, কারো কাছে প্রশংসিত হওয়ার মানসিকতা না থাকে বরং একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই যেন উদ্দেশ্য থাকে।

২. হাজ্জ্বের উদ্দেশ্যে বের হওয়া যেন দুনিয়া ত্যাগ করার মত হয়ে যায়, সুতরাং নিজের জীবনের অতীতের সমস্ত কবীরা-সগীরা গুনাহের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত এবং ভবিষ্যতে গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করে মহান আল্লাহর দরবারে তাওবা-এস্তেগফার করা এবং তাওবার নিয়তে দু’ রাকাত নামায আদায় করা।

৩. নিজের উপর কারো আর্থিক বা দৈহিক হক্ব থাকলে তা যথাসম্ভব পরিশোধ করা। অসামর্থবান হলে ক্ষমা চাওয়া এবং হকদার ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার উত্তরাধিকারীদের সাথে আর্থিক বিষয়টি নিষ্পত্তি করা এবং তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে সমপরিমাণ অর্থ ঐ হকদারের জন্য (প্রাপ্যব্যক্তির) সওয়াবের নিয়তে সদকা করা।

৪. হাজ্জ্বে যাওয়ার পূর্বে পরিবার পরিজনের খোর-পোষের ব্যবস্থা করে যাওয়া। কোন বিষয়ে নির্দেশনা থাকলে ওয়ারিশদের ওসিয়ত করে যাওয়া।

৫. অবশ্যই হালাল উপার্জন নিয়ে হাজ্জ্বে যাওয়া উচিৎ। কেননা হারাম উপার্জন দিয়ে হাজ্জ্ব করলে তা কবুল হবে না, যদিও হাজ্জ্ব করার কারনে হাজ্জ্ব করার দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। ইমাম গাজালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কেউ যদি হারাম উপার্জন দিয়ে হাজ্জ্ব করে তাহলে সে যেন হাজ্জ্বের সফরে নিজের খানা হালাল উপার্জন দিয়ে করে, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে ইহরাম অবস্থায় হারাম টাকা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে কমপক্ষে আরাফার দিন হারাম খানা থেকে বিরত থাকবে। কোন ব্যক্তি যদি হাজ্জ্বের ইচ্ছা পোষণ করে আর তার কাছে হালাল উপার্জন না থাকে তাহলে সে হারাম সম্পদ ব্যবহার না করে ঋণ করে হাজ্জ্ব করবে এবং পরবর্তীতে তা পরিশোধ করে দিবে।

৬. সুদকে নিজের জীবনের জন্য সর্বাবস্থায় হারাম হিসেবে গণ্য করে সুদের উৎসমূল নির্মূলে সচেষ্ট হওয়া। ঘুষ, প্রতারণা, পরের সম্পদ আত্মসাৎ, যাদুবিদ্যা চর্চা ও বিশ্বাস এবং জুয়া ইত্যাদি যাবতীয় নিষিদ্ধ সকল গর্হিত কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকার অঙ্গীকার করা।

৭. গীবত, অহংকার পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ সম্পূর্ণ পরিহার করা এবং হাজ্জ্বের পরেও এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা।

৮. ঋণ থাকলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা এবং বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হলে উত্তরাধিকারীদের তা অবগত করানো। যাতে যে কোন দুর্ঘটনায় তারা তা আদায় করতে পারে।

৯. নিজের স্ত্রীর মোহরানা বাকি থাকলে হাজ্জ্বের পূর্বেই তা আদায় করার চেষ্টা করা। অথবা স্ত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি বা পারস্পরিক সমাঝতায় ব্যবস্থা করা ও স্ত্রী, পুত্র-কন্যা তথা পরিবার পরিজনকে তাকওয়ার নীতি অবলম্বনে ইসলামের উপর অটল থাকার জন্য কড়া নির্দেশ দেয়া।

১০. হাজ্জ্বে যাওয়ার পূর্বে জীবিত পিতা-মাতার খেদমতের সুব্যস্থা করা, তাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নেয়া এবং হাজ্জ্বে তাদের কথা স্মরণ করে বার বার দোয়া করা।

১১. অপ্রয়োজনীয় কথা না বলে বেশি বেশি জিকির, দোয়া, দুরূদ, ‍মুনাজাত ইত্যাদিতে ব্যাস্ত থাকা এবং সকল স্থানে নারী-পুরুষ সকলের উচিৎ দৃষ্টিকে সংযত করে রাখা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।